তথ্যকে সাজিয়ে তথ্যমূলক লেখা তৈরি করা হয়। নিচে একটি তথ্যমূলক লেখা দেওয়া হলো। এটি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে লেখা। এটি রচনা করেছেন সেলিনা হোসেন। তিনি বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখক।
সেলিনা হোসেন
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহীর মোহাম্মদ আবু আলী সাবের প্রভূত ভূসম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। পায়রাবন্দ গ্রামে তাঁদের বাড়িটি ছিল বিশাল। সাড়ে তিন বিঘা জমির মাঝখানে ছিল তাঁদের বাড়িটি।
রোকেয়া যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে সময়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন ছিল না। ফলে মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষা, চাকরি, সামাজিক প্রতিষ্ঠার দিক থেকে পিছিয়ে ছিল। মেয়েদের অবস্থান ছিল। খুবই শোচনীয়। পর্দাপ্রথা কঠোরভাবে মানা হতো বলে মেয়েদের শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু মেধাবী রোকেয়ার প্রবল আগ্রহ ছিল লেখাপড়ার প্রতি।
রোকেয়ার বড়ো দুই ভাই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। বোনদের আগ্রহ দেখে বড়ো ভাই ইব্রাহীম সাবের বোন করিমুন্নেসা ও রোকেয়াকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। করিমুন্নেসার অনুপ্রেরণায় রোকেয়া বাংলা সাহিত্য রচনা ও চর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রোকেয়া তাঁর রচিত 'মতিচূর' দ্বিতীয় খণ্ড করিমুন্নেসাকে উৎসর্গ করেছিলেন। উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছিলেন, 'আপাজান! আমি শৈশবে তোমারই স্নেহের প্রসাদে বর্ণপরিচয় পড়িতে শিখি। অপর আত্মীয়গণ আমার উর্দু ও ফারসি পড়ায় তত আপত্তি না করিলেও বাঙ্গালা পড়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। একমাত্র তুমিই আমার বাঙ্গালা পড়ার অনুকূলে ছিলে।' নানা বাধা এড়িয়ে রোকেয়া আপন সাধনায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তাই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন একজন অসাধারণ নারী।
১৮৯৭ সালে কিশোরী বয়সেই বিহারের ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে রোকেয়ার বিয়ে হয়। স্বামীর সহযোগিতায় তিনি তাঁর পড়াশোনার চর্চা চালিয়ে যান। বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯০২ সালে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'নবপ্রভা' পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর প্রথম রচনা 'পিপাসা'। বিভিন্ন সময়ে তাঁর রচনা নানা পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। ১৯০৫ সালে প্রথম ইংরেজি রচনা 'সুলতানাজ ড্রিম' মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ছাপা হয়। তাঁর রচনা সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
১৯০৯ সালে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। রোকেয়া ভাগলপুরে তাঁর নামে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তখন স্কুলের ছাত্রী ছিল পাঁচজন। ১৯১১ সালে এই স্কুলটি তিনি কলকাতায় স্থানান্তর করেন। শুরুতে ছাত্রীসংখ্যা ছিল আট। আস্তে আস্তে স্কুলে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
রোকেয়া বাঙালি মুসলমান মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য শুধু স্কুলই প্রতিষ্ঠা করেননি, ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য বাবা-মায়ের কাছে আবেদন-নিবেদন করেছেন। এই কাজে তিনি ছিলেন একজন নিরলস পরিশ্রমী-কর্মী। তাঁর অক্রান্ত প্রচেষ্টার ফলে নারীশিক্ষার অগ্রগতি সূচিত হয়। মেয়েরা ধীরে ধীরে শিক্ষার আলোর দিকে এগোতে থাকে।
১৯১৬ সালে তিনি 'আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম' নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে দুস্থ নারীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করা হতো। তাদের হাতের কাজ শেখানো হতো, সামানা লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থাও ছিল। এক কথায় এই সংগঠনটির লক্ষ্য ছিল সমাজের সাধারণ দুঃস্থ নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলা।
রোকেয়ার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচটি: 'মতিচুর' প্রথম খণ্ড (১৯০৪), 'সুলতানা ড্রিম' (১৯০৮), 'মতিচূর' দ্বিতীয় খন্ড (১৯২২), 'পদ্মরাগ' (১৯২৪) ও অবরোধবাসিনী' (১৯৩১)।
রোকেয়া এই উপমহাদেশের একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। নারীশিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে সমগ্র বাঙালি সমাজে তিনি শ্রদ্ধেয়। বিংশ শতাব্দীর সূচনায় তিনি দুইভাবে নারীদের মুক্তির পথ দেখেছিলেন। এক. মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপন করে, দুই. নিজের রচনায় নারীমুক্তির দিকনির্দেশনা দিয়ে। তিনি ১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
শব্দের অর্থ
পর্দাপ্রথা= নারীদের ঘরের বাইরে না যাওয়ার সামাজিক রীতি।
অক্লান্ত= ক্লান্তিহীন।
অগ্রগতি= এগিয়ে চলা।
পারদর্শী= দক্ষ।
অগ্রদূত= পথপ্রদর্শক।
প্রচলন= চালু
অনুকূলে= পক্ষে।
প্রবল= খুব
অনুপ্রেরণা= উৎসাহ।
প্রভুত= প্রচুর।
বর্ণপরিচয়= বর্ণমালা শেখার বই।
বাঙ্গালী= বাংলা ভাষা।
প্রকাশ= আবির্ভাব।
বিংশ শতাব্দী= বিশ শতক (১৯০১-২০০০ সাল)।
আবেদন-নিবেদন= অনুরোধ।
উৎসর্গ-পত্র= বইটি কাকে উৎসর্গ করা হয়েছে বইয়ের যে পাতায় তা লেখা থাকে।
বিশাল= অনেক বড়ো।
ভাগলপুর= বিহারের একটি জেলাশহর।
উপমহাদেশ= দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ অঞ্চল।
ভূসম্পত্তি= জমিজমা
মাদ্রাজ= ভারতের একটি শহর। বর্তমান নাম চেন্নাই।
ঘোর= প্রবল।
শোচনীয়= অত্যন্ত খারাপ।
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট= সরকারি কর্মকর্তা।
গঠন= প্রতিষ্ঠান।
দিকনির্দেশনা= পথ দেখানো।
সামাজিক প্রতিষ্ঠা= সমাজে সম্মানজনক অবস্থা নিয়ে থাকা।
সেন্ট জেভিয়ার্স= একটি কলেজের নাম।
দুঃখ= অসহায়।
দুরদৃষ্টিসম্পন্ন= ভবিষ্যতে কী হবে তা খিনি আন্দাজ করতে পারেন।
স্থানান্তর= জায়গা বদল।
নারীমুক্তি= নারীর স্বাধীনতা।
স্নেহের প্রসাদে= আদরে।
স্বাবলম্বী= স্বনির্ভর।
পড়ে কী বুঝলাম
ক. এই লেখায় কী ধরনের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে?_____________
খ. এই লেখার কোন তথ্যটি তোমার ভালো লেগেছে?_______________
গ. এ ধরনের আর কী কী রচনা তুমি আগে পড়েছ?_____________
ঘ. কাদের নিয়ে এ ধরনের লেখা তৈরি করা হয়?_____________
ঙ. এই লেখা থেকে নতুন কী কী জানতে পারলে? _______________
বলি ও লিখি
‘রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’ রচনায় লেখক যা বলেছেন, তা নিজের ভাষায় বলো এবং নিজের ভাষায় লেখো।
কীভাবে লিখৰ তথ্যমূলক লেখা
মূলত তথ্য উপস্থাপন করা হয় যেসব রচনায়, সেগুলো তথ্যমূলক লেখা। তথ্য নানা ধরনের হতে পারে। তাই তথ্যমূলক লেখাও নানা রকম হয়। জীবনীও এক ধরনের তথ্যমূলক লেখা। এছাড়া, বিভিন্ন ধরনের বিশ্বকোষ গ্রন্থে কিংবা অনলাইনে উইকিপিডিয়ায় বহু ধরনের তথ্যমূলক লেখা পাওয়া যায়।
তথ্যমূলক লেখার সাধারণ কিছু নিয়ম নিচে উল্লেখ করা হলো
১. কী নিয়ে লেখা হবে, তা ঠিক করতে হয়।
২. লেখাটিতে কী ধরনের তথ্য থাকবে, তা নিয়ে ভাবতে হয়।
৩. প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হয়।
৪. ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তথ্যগুলো সাজাতে হয়।
৫. বিষয়ের সাথে মিল রেখে লেখাটির একটি শিরোনাম তৈরি করতে হয়।৬. তথ্যকে স্পষ্ট করতে ছবি, ছক, সারণি ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
তথ্যমূলক রচনার প্রভুতি
তোমরা দলে ভাগ হও। এরপর শিক্ষকের নির্দেশ অনুযায়ী তোমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এসব তথ্য সংগ্রহ করো।
১. প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
২. অবস্থান ও কাঠামো
৩. বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী
৪. বিভিন্ন কর্মকা
৫. অর্জন ও কৃতিত্ব
৬. প্রতিষ্ঠানের ছবি
প্রতিটি দলের সংগ্রহ করা তথ্য আলাদা আলাদা কাগজে লিখে বড়ো কাগজে সেঁটে দাও। বড়ো কাগজটি এমন এক জায়গায় রাখো যাতে সবাই দেখতে পায়।
বড়ো কাগজে সেঁটে রাখা তথ্যগুলো কাজে লাগিয়ে একটি তথ্যমূলক রচনা তৈরি হতে পারে।
আরও দেখুন...